সব বোঝা যায়না......
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যই হল প্রকৃতিতে যা কিছু ঘটছে তার কারণ বিশ্লেষণ করা। মেডিসিনে ও তাই। কিন্তু বিজ্ঞানের অন্য শাখার সাথে মেডিসিনের তফাৎ হল, এর সীমাবদ্ধ জ্ঞান। মেডিসিনের জ্ঞান প্রতিনিয়তই সমৃদ্ধ হয়। আজ যা ঠিক, কাল নতুন গবেষণায় দেখা যাবে, তা সম্পূর্ণ ভুল। আবার আজ যাকে ভুল বলে উড়িয়ে দিচ্ছি, কাল দেখা যাবে সেটাই সঠিক চিকিৎসা।
মেডিসিনের আরেকটি সমস্যা হল, এটি শুধু সম্ভাবনার কথা বলে। অর্থাৎ probability। সেটা আপনার ক্ষেত্রে ঠিক হতেও পারে, নাও হতে পারে। যেমন ধরুন বলা হল আপনার এই অপেরেশন হলে সুস্থ হবার সম্ভাবনা 8০%। অর্থাৎ আপনার মত ১০০ জনের অপেরেশন হলে ৪০ জন ভাল হয়ে যায়। এখানে কেউ বলতে পারবেনা আপনার ঠিক কি হবে। আপনি সেই ভালোর ৪০ জনের গ্রুপে পড়বেন, নাকি ৬0 জন দুর্ভাগ্যাপীড়িত মানুষের দলে। এর উত্তর একমাত্র অপেরেশন হলেই জানা যাবে।
মোট কথায় মেডিক্যাল সায়েন্সে "গ্যারান্টি" বলে কিছু হয়না। সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ করে heart attack হয়ে মারা যেতে পারেন। .এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক শুধুমাত্র চিকিৎসা দিতে পারেন, গ্যারান্টি নয়।
ঠিক সেরকম probability র জায়গা হল INFERTILITY। আমরা শুধু বলতে পারি আপনার মা হওয়ার সম্ভাবনা কতটা। আর কোন চিকিৎসাতে সম্ভাবনা কতটা। তার বেশি নয়।
খুব কম ই দম্পতি আছেন যাদের আমরা বলি, স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা আসবেনা, যেমন যাঁদের শুক্রাণু একদম ই নেই, ডিম্বাশয় বা জরায়ু বাদ দেওয়া হয়েছে তাদের। বাকি দের আমরা সম্ভাবনার কথাই শুধু বলি।
যদি খুব বেশি সমস্যা না থাকে, আমরা বলি কিছুদিন নিজেরা চেষ্টা করুন। ১00 জন চেষ্টা করলে এক মাসে ১৫ জনের বাচ্চা আসে, অর্থাৎ success rate বা সফলতার হার ১৫%। অনেকেই তখন বলেন, "কবে আসবে, কতদিন লাগবে, হবে তো ডাক্তারবাবু?" আমরা বলি উত্তর জানিনা। অনেকেই আশা করেন কোন উত্তর পাবেন। কিন্তু আমরা শুধু বলতে পারি, সম্ভাবনা কতটা। গ্যারান্টি দিতে পারিনা। কি আর করা যাবে, ডাক্তাররা যে হাত দেখতে জানেন না।
যখন কাউকে বলা হয় ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করা, অর্থাৎ OVULATION INDUCTION, তাতেও এই এক ই সম্ভাবনার গল্প। কতদিন লাগবে, আদৌ এতে আসবে কিনা গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেন না। যদি কেউ বলেন, আমাকে অমুক জায়গায় গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, তাহলে তা অবৈজ্ঞানিক। কারন এতেও সফলতার হার ১৬-১৭%. অর্থাৎ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে কেউ যদি বলেন, এই মাসেই হয়ে যাবে, তাঁর সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা তো ১৬-১৭% থাকছেই। তবে ৬-৭ মাসের মধ্যে ওষুধ খেয়ে না এলে, আরো ওষুধ খেয়ে বাচ্চা আসার সম্ভাবনা কম। তাই সে ক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসাতে যাওয়া ভাল। তখন অনেকে বলেন, "ওষুধে কি আসবেই না"। আমরা বলি, ওই যে "খুব কম দম্পতি ই থাকেন যাঁদের নিজে থেকে স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা আসবেনা"। অর্থাৎ ৬-৭ মাসের বেশি ওষুধ খেয়ে গেলে এই পদ্ধতি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু শুন্য (ZERO) কখনোই নয়।
তারপর যখন বলা হয় IUI (Intrauterine Insemination) এর জন্য, সেখানেও সেই সম্ভাবনার খেলা। এক এক বারে ১৮-২0%। এটিও ৪-৬ বারের বেশি করা যুক্তিসঙ্গত নয়।.অর্থাৎ ovulation induction বা IUI নির্দিষ্ট কিছু মাস করলে যদি প্রেগন্যান্সি না আসে, আরো কয়েকমাস ধরে একই চিকিৎসা করে গেলে তার সফল হবার সম্ভাবনা কম কিন্তু শূন্য নয় কখনোই।
এবারে আসি IVF (In Vitro fertilization)। সম্ভাবনা ৪0%। কিন্তু মনে রাখবেন এটি সম্ভাবনা। আপনার ক্ষেত্রে কি হবে কেউ বলতে পারবেনা। যদি আপনার প্রেগন্যান্সি আসে, আপনার কাছে সফলতার হার ১00%, আর যার আসছেনা তার কাছে সফলতার হার হল শূন্য। এখানে আরো কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। ওষুধ বা ইনজেকশন নিলে ফলিকল (যে থলিতে ডিম্বাণু থাকে) তৈরি হবে, কেউ জানেনা। সেজন্য ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরে TVS (এক ধরনের ultrasound) করে দেখা হয় কটা ফলিকল হচ্ছে। অর্থাৎ ইনজেকশন নিলেই কাজ হবে, কোন গ্যারান্টি নেই।তারপর যখন OT তে ডিম্বাণু সংগ্ৰহ করা হয় (ovum pick up) তাতেও কেউ জানেনা সব কটা ফলিকল এই ডিম থাকবে কিনা। আর ডিম বেরলে ও সেই ডিম পরিণত (mature) হবে কিনা একমাত্র ল্যাবরেটরি তে পরীক্ষা করেই বলা সম্ভব। আগে থেকে বলা যায়না। আবার পরিণত ডিম মানেই ভাল কোয়ালিটি না হতে পারে।
শুক্রাণুর কোয়ালিটি ও সবসময় আগে থেকে বোঝা কঠিন। বিশেষ করে যদি পুরুষের শুক্রাণুর সমস্যা থাকে এবং TESA পদ্ধতি ব্যবহার করে অন্ডকোষ থেকে শুক্রাণু সংগ্ৰহ করতে হয় তবে কতটা ভালমানের শুক্রাণু পাওয়া যাবে তা নির্ভুল ভাবে আগে থেকে বলা যায়না।
এবার ভাল কোয়ালিটির হলেও ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণু কতটা মিলিত হয়ে ভ্রুন গঠন করবে তাও অনিশ্চিত। ICSI পদ্ধতি ব্যবহার করলেও ভ্রুন তৈরি হবে কিনা বলা কঠিন।
আর ভ্রুন তৈরি হলেও তার কোয়ালিটি কেমন হবে তা একমাত্র ল্যাবরেটরিতেই পরীক্ষা করে বলা সম্ভব। আবার Freezing করলে বা blastocyst culture করলে এই ভ্রুনের কি পরিণতি হবে, সেটাও একটা সম্ভাবনা মাত্র।এত কিছু বাধা পেরিয়ে যখন ভাল কোয়ালিটির ভ্রুন জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা হয়, তারপর প্রেগন্যান্সি আসার সম্ভাবনা ৪0% আর এর মধ্যে take home baby rate ৩০%। অর্থাৎ ১০০ জনের IVF হলে ৪০ জনের প্রেগন্যান্সি পসিটিভ হয় আর ৩০ জন বাচ্চা নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন।
শুনে হয়ত মনে হবে এত পুরো হতাশার গল্প, শুধু নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। তাই বলে কি চিকিৎসা করলে বাচ্চা আসছে না। একদম সঠিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম বারে না হোক, চেষ্টা করতে থাকলে এবং সঠিক চিকিৎসা করলে সন্তান চলে আসে। এমন কি IVF ব্যর্থ হওয়ার পরেও নিজে থেকে সন্তান হতেও দেখা যায়।
কিন্তু নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করার আগে সব কিছু বুঝে শুনে এগলে এবং বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা থাকলে সঠিক ফল পাওয়া যেতে পারে।
জিনিসটা অনেকটা রাস্তা পার হওয়ার মত। ধরুন আপনি ভাবছেন এই রাস্তা পার হয়ে ওই দোকান থেকে মিষ্টি কিনে বাড়ি চলে আসব। কিন্তু সত্যি যে আসতে পারবেন, কোন নিশ্চয়তা আছে কি? নেই ঠিকই তবুও আমরা আশা করতে ছাড়িনা।
Infertility র চিকিৎসাও ঠিক তাই। লড়াই টা আপনার একার নয়। এটা ঠিক, সামাজিক প্রশ্ন, অস্বস্তি, চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যা, খরচ সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আপনি একা যাচ্ছেন, কিন্তু আসল লড়াই টা আপনার সাথে আপনার ডাক্তারবাবু ও করছেন। অনেকদিন ধরে দেখতে দেখতে রুগীদের সাথে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও তৈরি হয়। তাই চিকিৎসা ব্যর্থ হলে ডাক্তারবাবুর ও কষ্ট হয়, একটা জেদ চেপে যায় "এই দম্পতি আমার ওপর এত ভরসা করছেন, এদের জন্য কিছু করতেই হবে"। অথচ সবাই ই জানেন চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা আছে, চাইলেই সব হয়না। তার জন্য লড়াইয়ের আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। খেলাটা আপনাকেই খেলতে হবে এবং সেটা অসম প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম "PROBABILITY"। সেখানে আপনার কোচ হলেন আপনার চিকিৎসক। আপনি জিতলে তিনিও জিতবেন আর আপনার হার মানে তাঁর ও পরাজয়। শুধু জানতে হবে এবং বুঝতে হবে যে হারজিত একটা সম্ভাবনা, আসল খেলার ময়দানে কি হবে আগে থেকে ভবিষ্যৎ বাণী করা যায়না। কিন্তু একবার খেলতে নামলে খেলাটা ভাল করে খেলতে হবে।